Privacy

গুগল যেভাবে আড়িপাতে

আমার ল্যাপটপটা কেনা হয়েছিল ২০১৫ সালে। যখন কিনেছিলাম তখন আমারটাই ছিল প্রায় বেস্ট টাইপ। কালের বিবর্তনে এখন এটি লক্কর-ঝক্কর মার্কা। যা হোক, ওই সময় ল্যাপটপ কিনব বলে নিয়মিত ল্যাপটপের রিভিউ দেখি। কোনোটা চিকনচাকন দেখে পছন্দ হলেও কনফিগারেশন ভালো না, আর যেটার সব পছন্দ হয় তার দাম দিয়ে আমাকে দুই-তিনবার কেনা যাবে। কোনোভাবেই ব্যাটে-বলে মিলছিল না। তখন আমার বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মাত্র শেষ হয়েছিল। হাতে কোন কাজ ছিল না এসব ব্রাউজ করা ছাড়া তাই সারাদিন অনলাইনে ল্যাপটপ খুঁজি। শেষ পর্যন্ত ল্যাপটপ কিনব বলে মন স্থির করলাম। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভাইকে স্কাইপে কল দিয়ে বললাম, ভাইয়া কিনে ফেলি। ভাইয়া বললেন, দেশ থেকে নিয়ে নাও। আমি বললাম, যা দাম, একটা ডেল পছন্দ হয়েছিল, কিন্ত লাখের উপরে চলে যায়। ভাইয়া বললেন, স্লিম কিছু নিতে চাও? ক্রোমবুক ভালো, ওইটা নাও না কেন, বাজেট প্রবলেম নাই। এই আলাপে তিনটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ। এক - স্লিম, দুই - ক্রোমবুক, তিন - বাজেট প্রবলেম। আমরা এই নিয়ে অনেক আলাপ করলাম। ক্রোমবুকে কী কী ঝামেলা আর কোনটা ভালো এইসব নিয়ে ইনফরমাল কথাবার্তা আর হাসাহাসি। কথা শেষ হলে কল কেটে আমি ঘুমাতে গেলাম।

ভাইয়ের সঙ্গে ল্যাপটপ নিয়ে কথা বলছিলাম স্কাইপে; গুগল বা ইয়াহু কোনও সার্চ ইঞ্জিনেই সার্চ ইনিশিয়েট করিনি এ নিয়ে। বা কোথাও ক্রোমবুক শব্দটাই লিখিনি। পরের দিন সকালে যখন আমি ল্যাপটপ চালু করলাম তখন আমার ভিজিট করা বিভিন্ন সাইটের ডানপাশে আর উপরে দেখি বিজ্ঞাপন ব্যানার। সবগুলো ব্যানারে গুগল ক্রোমবুকের বিজ্ঞাপন। একটা ব্যানারে লেখা 'স্লিম ক্রোমবুক', আরেকটাতে লেখা 'ক্রোমবুক আন্ডার $500'। আমার কাছে তখনই বেশ খটকা লাগলো ব্যাপারটা, যেখানে আমি গুগল ক্রোমবুক নিয়ে বেশি কিছু জানিই না, গত সপ্তাহখানেকে আমার করা সার্চে ক্রোমবুকের কোন নামই নেই সেখানে রাতারাতি সব সাইটে কীভাবে আমার বাজেটের মধ্যে সব ক্রোমবুকই দেখাচ্ছে? তাহলে স্কাইপে আমরা কী বলি না বলি সবই গুগল কান পেতে শোনে? স্কাইপের সাথে তো গুগলের কোনও সম্পর্ক নাই, সে ক্ষেত্রে কীভাবে শোনার কথা? আবার অবিশ্বাসও করতে পারছি না, কারণ এক সাথে সব সাইটে ক্রোমবুকের অ্যাড দেখানো কোনভাবেই কাকতালীয় না। এখন প্রশ্ন হলো, গুগল যদি আমার স্কাইপের আলাপ শুনে আমাকে অ্যাড দেখাতে পারে তাহলে তো সে আমার নিত্যদিনকার কথাও শুনতে পারে।

ব্লগে 1,350 জন সাবস্ক্রাইব করেছেন,
ব্লগে প্রকাশিত লেখা ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

এখন আসি ভয়ংকর এক ঘটনায়। শনিবার ঈদের দিন ছিল। ঈদের আগের দিন যে কোন ভাবেই হোক আমাদের বাড়ির পানির পাম্প জ্বলে গেছে। ঈদের দিন বাবা এসে বলছেন পানির মটর একটা কিনতে হবে। আমি তখন বান্ধবীর সাথে ফোনে ভাইবারে চ্যাট করি। বলে রাখি, আমার ফোন অ্যান্ড্রয়েড, আর অ্যান্ড্রয়েডে প্লে স্টোর যে অ্যাকাউন্ট দিয়ে লগইন করা, ওই একই অ্যাকাউন্ট দিয়ে আমার পিসিতে গুগল ক্রোমেও লগইন করা। এদিকে কথায় কথায় বাবা মাকে বলছে এইবার একটা সাবমারসিবল পাম্প কিনে ফেলতে হবে, বারবার এই কষ্ট ভালো লাগে না। আমি বান্ধবীর সঙ্গে চ্যাট করতে করতেই জিজ্ঞেস করি, সাবমারসিবল পাম্প যে মাটির নিচে রাখে, নষ্ট হলে কীভাবে উঠায়, দাম কত পড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি... সাবমারসিবল পাম্প ওয়ার্ডটা যে আমি অনেকবার ব্যবহার করেছি ফোন হাতে চ্যাট করার সময় সেটা আমার খুব ভালো করেই খেয়াল আছে। সারা দিন কাটিয়ে রাতে যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম তখন নিউজপেপার খুলে আমার আক্কেল গুড়ুম। বিবিসির ওয়েবসাইটে ডান কোনায় আলিবাবা ডট কমের 'সাবমারসিবল পাম্প' এর একটা বিজ্ঞাপন। ইউএসএ টুডে ওয়েবসাইটের একদম উপরে একটা ব্যানার, সেটাও 'সাবমারসিবল পাম্পের'। এমনকি কালের কন্ঠ পত্রিকার ডান পাশে 'সাবমারসিবল পাম্প' নিয়ে আলিবাবা ডট কমের বিজ্ঞাপন। আমি যখন বাবার সাথে 'সাবমারসিবল পাম্প' নিয়ে কথা বলি তখন ওই রুমে আমার ল্যাপটপ ছিল না। আমার হাতে ছিল একটাই ডিভাইস, সেটা আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোন। যেহেতু আমি চ্যাট করছিলাম ওই সময়, তার মানে তখন ইন্টারনেট সংযোগ ছিল। আমি আমার ফোনে হাতে গোনা তিন-চারটা মাত্র অ্যাপ ইউজ করি, আর আমার ফোনে কোন গেমস বা আজব কোনও অ্যাপও ইন্সটল করা নেই। আমার ফোন থেকে 'সাবমারসিবল পাম্প' শব্দ দিয়ে কোনও সার্চ আমি করিনি, আর পিসি থেকেও করিনি। কিন্তু একসাথে এতগুলো ওয়েবসাইটে 'সাবমারসিবল পাম্পের' বিজ্ঞাপন দেখানোটাও কোন ভাবেই কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না। তাহলে সব যোগ-বিয়োগে ব্যাখা একটাই থাকে, তা হচ্ছে আমি যখন আমার ফোন ইউজ করি তখনও গুগল সব কথা রেকর্ড করতে থাকে, যখন ইউজ করি না তখনও সব রেকর্ড হতে থাকে। যেহেতু আমার ফোন (অ্যান্ড্রয়েড) গুগল বেজড প্রোডাক্ট, তার মানে আমার ফোন যতক্ষন ওপেন করা থাকে ততক্ষনই সে কোনো না কোনোভাবে আমার কথা শুনতে থাকে তারপর আমার গুগল মেইলের সাথে কানেক্ট থাকা সব ডিভাইসে অটোমেটিক সেই রিলেটেড অ্যাড দেখাতে থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো, গুগল কি সত্যি সত্যিই আমাদের এই নজরবন্দির ভেতরে রেখে দিয়েছে? অনলাইনে একটু খুঁজে দেখলাম, আমার এই ধারনা অমূলক নয়। ব্যবহারকারীদের কথা শোনার এই অভিযোগটি গুগলের বিরুদ্ধে অনেকেই করেছেন (দেখতে পারেন নিচের ভিডিও ক্লিপটি)।

 

যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কোথায় এখন? একজন যখন ফোন নিয়ে ঘুমান,  প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর সময় ফোনটিও পাশে থাকে, কারো সাথে ঝগড়ার সময় ফোন হাতে থাকে, খুব গোপন কোন ডিল করার সময় হাতের কাছে কিছু থাক না থাক ফোন থাকে। গুগল যদি আমাদের সব কথা শুনতে পায়, তাহলে সে কি সেই কথা কোথাও জমা রাখে? যদি রাখে তাহলে তার রক্ষনাবেক্ষনকারী কে? অ্যান্ড্রয়েড ফোন ইউজারদের  ফোন দিনে কতবার লক-আনলক হয়, ব্যবহারকারী কোন ওয়েবসাইটে ভিজিট করেছেন সব তথ্য গুগল রেখে দেয়।

ধরা যাক, ব্যবহারকারী তার ব্রাউজারে পর্নগ্রাফিক সাইট ব্রাউজ করে এরপর সেই ব্রাউজিং হিস্ট্রি মুছে দিলেন; কিন্তু তাতে আসলে সবকিছু মুছে যায় না। গুগলের মাই অ্যাকটিভিটি লিংকে গেলেই দেখা যাবে মুছে দেওয়া তথ্যও জমা আছে। যদি সেখান থেকেও মুছে দেওয়া হয় তাহলে দুইবার দুই জায়গা থেকে মুছে দেওয়া হিস্ট্রি টেকআউট লিংকে জমা থাকবে। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর  ব্রাউজ করা যে কোনও তথ্য গুগলের হাতে বন্দি। কিন্ত ব্রাউজ করি নি, শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা শব্দের ক্ষেত্রেও গুগল যদি স্পাইং করতে থাকে তাহলে ব্যাপারটা অতি মাত্রায় ভয়ংকর পর্যায়ে চলে যায়। আধুনিক প্রযুক্তিতে জীবন সহজ করার নামে আমরা আমাদের সব কিছুই দিয়ে দিয়েছি। মানুষ হিসেবে একান্ত যে 'প্রাইভেসি' টুকু থাকার কথা তাও এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

বিডিনিউজ লিংক

Leave a Comment