Phobjikha Valley

ভুটান ডায়েরি – ফোবজিখা কথন

আমি মারাত্নক রকম ঘরকুনো মানুষ। আমার পার ক্যাপিটা হ্যাপিনেসের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে আমার নিজের ঘরে। এই বদ অভ্যাসের কারণে আমার বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয় কম, সুন্দর সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করার অবস্থাও তাই নাই। এই আমার চোখে যখন হঠাৎ প্রকৃতির অদ্ভুত সুন্দর কোন ছবি ধরা পরে, তখন মাথা খারাপের মত অবস্থা হয়। এখনো মনে আছে, প্রথমবার যখন সেন্টমার্টিন যাই, তখন দূর থেকে সমুদ্র দেখে “দেড় মাসের মত পাগল আছিলাম” টাইপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। এরপর অনেক দিনের বিরতি। এইবার “তিন মাসের মত পাগল আছিলাম” টাইপ সুন্দর জায়গা দেখে আসলাম ভুটান থেকে। সেই ফোবজিখা ভ্যালির গল্পই বলি আজ। ভুটান পুরোটাই ছবির মত সুন্দর, সেই সুন্দরের মধ্যে সুন্দরতম ফোবজিখা। ফোবজিখার গল্প রসায় রসায় বলব এটাই স্বাভাবিক, এটাই সাইন্স।

ভুটান যাওয়ার প্ল্যান যখন হচ্ছিল - তখন থিম্পু, পারো, হা-ভ্যালি সব প্ল্যান করা হলেও ফোবজিখার নাম গন্ধও ছিল না। আমাদের দৌড় - ব্লগ পড়া, ইউটিউব দেখা, ট্রাভেল গ্রুপে খোঁজ খবর নেয়া এই পর্যন্তই। ফোবজিখা নামটা খুব কম বার আসায় আমরাও তেমন জানতাম না। ট্যুরের দুই দিন আগে হঠাৎ এক বন্ধু গ্রুপে ফোবজিখার এক ইউটিউব ভিডিও দিল, ব্যাস সবার মাথা খারাপ। অবস্থা এমন দাড়াল যে - ধুর দরকার হইলে সব বাদ, শুধু ফোবজিখা।

এরপর নির্ধারিত সময়ে ব্যাপক সংগ্রাম শেষে আমরা ভুটানে পৌছুলাম। ভুটানে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল আসলে কোন দেশ না, ছবির মধ্যে এসে পড়েছি। দুইদিন ঘুরলাম, তারপর চলে আসল ফোবজিখা যাওয়ার সময়। ফোবজিখার আরেক নাম গাংতে ভ্যালি, থিম্পু থেকে মাত্র ১৩৭ কিলোমিটার পথ। কিলোমিটারের হিসাব শুনে মনে হয় এই তো একদম সামনে বুঝি। কিন্ত একদম আঁকাবাঁকা প্যাচানো পথ, আর ৩০০০ মিটার উপরে উঠতে কলিজা বের হয়ে যাবে। গাড়িতে বসে আছেন, হঠাৎ দেখবেন মাথা ঘুরাচ্ছে। মাথা ঘুরানো শেষ হলে দেখবেন কানে তালা লেগে যাওয়ার মত অবস্থা হচ্ছে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। স্রষ্টা আর মাদার ন্যাচার কোন কিছু এত সুন্দর করে বানাতে পারে, আর মানুষ সেই সুন্দরের কতটুকু ভিন্ন মাত্রা দিতে পারে তার পুরো অভিজ্ঞতাই পেয়েছি ফোবজিখা ভ্যালি যাবার রাস্তায়। বাই দ্যা ওয়ে ফোবজিখা কিন্ত রামসার সাইট, সম্পূর্ণ সংরক্ষিত জলাভূমি।

ব্লগে 1,350 জন সাবস্ক্রাইব করেছেন,
ব্লগে প্রকাশিত লেখা ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

ফোবজিখাতে শীত পড়বে সেটা আগেই জেনে গিয়েছি, কিন্ত বাঙালি এই শরীরের রক্তে সেই শীত যে কাঁটার মত বিধবে বুঝি নি। জ্যাকেট যথেষ্ট মোটা, তার নিচে ওয়ার্ম ওয়্যার ও ছিল, তবুও ঠান্ডায় দাঁত কপাটি লাগার মত অবস্থা। সকালে রওনা হয়েছি যখন, তখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা সন্ধ্যা অবস্থা - গাড়ির জানালা খোলা মাত্র বুঝলাম আজকে ঠান্ডা “আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম” টাইপ ভূমিকায় আছে। হাতের ঘড়ি বের করে দেখলাম ততক্ষনে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাড়ি এক ফার্ম স্টের সামনে থামল। ফোবজিখা প্রচলিত অর্থে খুব নামী কোন ট্যুরিস্ট প্লেস না, হোটেলও তাই তূলনামূলক কম। থাকতে হলে ওই ফার্ম স্টে কিংবা হোম স্টে-ই ভরসা। বেশ খানিক ঘুরে আমরা এমন এক ফার্ম স্টে তে উঠলাম। সব কিছু সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, আর বেসমেন্টে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। অদ্ভুত সুন্দর সব কিছু।

আসার সময় উপর থেকে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ি প্যাচানো পথে নামার সময়ই বড় বড় সাদা-কালো পাখি দেখেছি, এবার বের হলাম সেই পাখি সামনে থেকে দেখতে। পাখির নাম ব্ল্যাক নেকড ক্রেন। ভুটানিজরা এই পাখিকে বলে সৌভাগ্যের পাখি। বিশ্বাস করা হয় এই পাখি যত বেশি আসবে তত তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। এই পাখির যাতে কোন ক্ষতি না হয় তা দেখার জন্য ফোবজিখায় এক ক্রেন সেন্টার আছে, সেই ক্রেন সেন্টার থেকে সারাদিন লক্ষ রাখা হয় কেউ অযাচিত ভাবে পাখির কাছাকাছি চলে যায় কিনা।

রাত ৮ টায় খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা বের হলাম অন্ধকারে হাঁটতে। বারবার বলে দেয়া হল যাতে আমরা ব্ল্যাক ক্রেনের সামনা সামনি ভুলেও না যাই, তাতে পাখিরা ভয় পেতে পারে। এরপর আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া, ঠান্ডায় কান হাত জমে যাওয়া। কী সুন্দর এক সময়! রাত হলেও আকাশের আলোয় মায়াবী এক পরিবেশ। স্বর্গের ছোট্ট এক ডেমো যেন। প্রায় ৭ কিলোমিটার হেঁটে, মাঝে মধ্যে আড্ডা দিয়ে রাত ১০ টায় ফিরে আসলাম ঘরে। রাত ৯ টার পরে যেহেতু খাওয়ার ব্যবস্থা নেই তাই আগেই বিস্কিট চকলেট কফি কিনে রেখেছিলাম, রুমে এসে যথারীতি বিশাল আড্ডা মারতে মারতে সবই পেটে গেল। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২ টা। হিটার চলার পরেও ঘরে বেশ ঠান্ডা, ঘড়িতে তাপমাত্রার ঘরে তখন দেখাচ্ছে মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

Black-necked crane

পরের ভোরে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম সূর্যোদয় দেখব বলে। তাই মাত্র ৩ ঘন্টা ঘুমিয়েই উঠে গেলাম। গ্লাভস, জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বাকি সবাইকে উঠিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা হাতে। ব্যালকনিতে এসে চোখ চড়কগাছ। কাল আসার সময় যে ভ্যালি দেখেছি সবুজে সবুজে ভরা, আজ তার পুরোটা সাদা। বরফের পাতলা সাদা এক স্তর এসে ঢেকে দিয়েছে পুরো ভ্যালি। সূর্য যত উপরের দিকে উঠছে ভ্যালি আবার সাদা থেকে সবুজ হচ্ছে, ব্ল্যাক ক্রেন আবার তারস্বরে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ভোরের সেই রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা সবাই ডিসিশন নিলাম বিয়ে করলে অবশ্যই ভুটানিজ করব, কোন ছাড়াছাড়ি নাই। বাংলাদেশ হবে নিজের বাড়ি, ফোবজিখা শ্বশুর বাড়ি।

Phobjikha Valley 4

এরপর আমাদের ফেরার পালা। আমাদের নিত্য সঙ্গী তাশি ভাই বলল, চলো ঘুরিয়ে আনি পুরোটা। গাড়িতে যেতে যেতে পুরো ভ্যালি দেখা আর এক গাদা ছবি তোলা। চলে আসার শেষ মুহুর্তে বন্ধুর মাথায় আসল এত সুন্দর জায়গায় বাংলাদেশের কোন পতাকা থাকবে না? আমরা তাই নিজের দেশের ছোট্ট এক পতাকা গেঁথে দিয়ে আসলাম স্বর্গসম এক ভ্যালিতে।

আমার গল্প ফুরোলো, নটে গাছটিও মুরোলো। কিন্ত সুন্দর তো ফুরায় না, সেই সুন্দর ধরতে হলে যেতে হয় ফোবজিখাতে। স্বর্গ সমান ফোবজিখাতে…

12 Comments

  1. অনেক দিন আগে প্রয়োজনে গিয়েছিলাম। ফোব্জিকায় যাই নি, থিম্পু-পারোতে ছিলাম। সত্যিই ছবির মত সুন্দর দেশ আর মানুষগুলোও কেমন ভালো।

    1. হ্যায় ভাই। আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার যে ছিল – এই লোক এত ভালো ছিল। আমাদের সাথে আকাশ পাতাল তফাত এদের। আর এত সুন্দর জায়গায় থাকলে মন তো ভালো হবেই।

  2. ভাই ভুটান কবে গেসিলেন? ট্যাক্স বসানোর আগে নাকি ট্যাক্স এর পরে? কত পড়ছিল?
    ছবি দেখে তো আমার এখন যেতে মন চাচ্ছে। করোনা গেলে যাব। জানাইয়েন খরচপাতি
    কেমন।

    1. শোভন, গেছিলাম তো ডিসেম্বরে ভাই। তখনো ট্যাক্স ছিল না। তবে ট্যাক্স হইলেও ঘুরে আইসো। আমার তখন ১২০০০ এর মত লাগছিল/পারসন।

    2. ও আমরা ৬ জন ছিলাম। ৪/৬ জন গেলে খরচ কমব, এছাড়া গেলে খরচ ২০০০০ এর উপরে চলে যায়।

Leave a Comment